জাতীয় পরিচয় পত্রে দুজনের নামই মোঃ আয়ুব আলী। বর্তমানে দুজনের বাড়িই মাগুরা পৌরসভার নিজনান্দুয়ালী গ্রামে। তবে বাবা মায়ের নাম ভিন্ন। এ দুজনের মধ্যে এক জনের নামে ২০১৭ সালে পাবনা সুজানগর থানায় শিশু ধর্ষণের একটি মামলা হয়। ওই সময় মামলার বাদি ‘ভুল’ করে এক আয়ুবের বাবার নাম অন্য জনের সঙ্গে জুড়ে দেন। সেই ভুলের সূত্র ধরে ওই মামলায় অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে রেখে অন্য আয়ুব আলীকে ধরে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৪ জুন পাবনার সুজানগর থানায় এক নারী অপহরণ পূর্বক ধর্ষণ ও সহায়তার অভিযোগে একটি মামলা করেন (মামলা নং এন/এস ২৯৪/১৭, সূত্রঃ জি আর ১০৩/২০১৭ সুজানগর)। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলায় বাদির পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া (ওই সময় বয়স ১১ বছর ৬ মাস) মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। সেখানে মাগুরা পৌরসভার নিজনান্দুয়ালী গ্রামের মোঃ ওমেদ শেখের ছেলে মোঃ আয়ুব শেখ নামে একজনকে মূল অভিযুক্ত এবং পৌরসভার বাটিকাডাঙ্গা এলাকার দুজন নারীকে আসামী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মামলায় যে দুজন নারীকে আসামী করা হয় তাঁরা দুজন সম্পর্কে বাদির পুত্র বধূ ও তাঁর মা। আর মূল অভিযুক্ত আয়ুব আলী বাদির পুত্র বধূর ভগ্নিপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ওমেদ শেখের ছেলে আয়ুব আলী। বর্তমানে পাবনা জেলা কারাগারে আছেন তিনি।
অভিযোগে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল বাদির ছেলের শ্বশুরের মৃত্যুর কুলখানির দাওয়াত দিতে অভিযুক্ত ব্যাক্তি বাদির বাড়িতে যান। ওইদিন সকাল ১০টার দিকে মেয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় তাঁকে তুলে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন বাদি। এরপর ৭ এপ্রিল মেয়েটি বাড়ি ফিরে পরিবারকে জানায় তাঁকে আয়ুব নামে ওই ব্যাক্তি ধর্ষণ করেন। তবে ধর্ষণের ঘটনাটি ঠিক কোথায় ঘটেছে সেটা এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি। এর প্রায় দুই মাস পর ওই বছরের ৪ জুন মামলা করেন ভুক্তভোগী শিশুর মা। গত বছরের ১৪ জুলাই এই মামলার রায় ঘোষণা করেন পাবনা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ মিজানুর রহমান। সেখানে আসামী মোঃ আইয়ুব শেখের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দণ্ডিত করা হয়। অন্য দুই আসামীকে এই মামলায় খালাস দিয়েছেন আদালত।
এই মামলায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মাগুরা পৌরসভার নিজনান্দুয়ালী পূর্বপাড়ার বাসিন্দা মোঃ আয়ুব আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি পাবনা জেলা কারাগারে রয়েছেন। তবে এই ব্যাক্তির পরিবারের দাবি, যে মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই ঘটনার সঙ্গে তাঁর কোন সম্পৃক্ততা নেই। তাঁর ছেলে মোঃ শিমুল শেখ বলেন, ‘আমার বাবার নামে এমন মামলা কখনোই হয়নি। মামলার বাদি, ভুক্তভোগী তাঁদেরকে কাউকেই আমরা চিনি না। এই মামলার আসামী অন্য ব্যাক্তি। পুলিশ ভুল করে আমার বাবাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। কোন অপরাধ না করেই আমার বাবা সাজা খাটছে। আমি এই ঘটনায় ন্যায় বিচার ও বাবার মুক্তি চাই’।
ওই এলাকার বাসিন্দা, মূল আসামীর স্বজন, মামলার অন্য আসামী ও নথী বিশ্লেষণ করে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। মামলার নথী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ২১ জুন এই মামলায় মোঃ আয়ুব আলী খান নামে একজন গ্রেপ্তার হন। ওই সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক একে এম শফিকুল আলম আদালতে দেওয়া পুলিশ চালানে উল্লেখ করেন মামলার এজাহারে আসামীর বাবার নাম ও ঠিকানা ভুল রয়েছে। ২০২১ সালের ২১ মার্চ তাঁর জামিন হয়। জামিন নামায় ওই ব্যাক্তির বাবার নাম লেখা হয় মোঃ যদন আলী খান। তিনি মাগুরা পৌরসভার নিজনান্দুয়ালী কাটাখালী আশ্রয়কেন্দ্র এলাকার বাসিন্দা। স্থানীয় জামিনদার হিসেবে তাঁর জামিননামায় সাক্ষর করেন তাঁর ছেলে সাগর খান।
গত বুধবার সরেজমিনে ওই আয়ুব আলীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা দুজনই ওই মামলায় আয়ুব আলীর আসামী হওয়া ও প্রায় দুবছর কারাবরণ করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ওই ব্যাক্তির স্ত্রী বুধবার বলেন, ‘পারিবারিক বিরোধের জেরে আমার বাবার অন্য পক্ষের মেয়ের শাশুড়ি ষড়যন্ত্রমূলক এই মামলা করে। আমার স্বামী ওসব কিছুই করেনি। পুরো ঘটনা বানোয়াট। আমাদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেছিল কিন্তু আমরা দিতে পারিনি। আমি তখন বিদেশে ছিলাম। আমার ছেলেরাও অনেক ছোট ছিল। মিথ্যা এই মামলায় আমাদের অনেক ভোগান্তি হয়েছে। এই মিথ্যা মামলা থেকে আমার স্বামীর মুক্তি চাই’।
যেভাবে বাবার নামে ভুল
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে মামলার আসামী আয়ুব আলীর বাবার নাম মোঃ যদন আলী খান। তাঁদের মূল বাড়ি জেলার মহম্মদপুর উপজেলার ঘুল্লিয়া গ্রামে। তবে দীর্ঘদিন ধরে আয়ুব আলী পৌরসভার নিজনান্দুয়ালী কাটাখালী আশ্রয় কেন্দ্রের বাসিন্দা ছিলেন (চার বছর আগে আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে জায়গা কিনে বাড়ি করেছেন)। ওই একই আশ্রয় কেন্দ্রে কয়েকটি ঘর ব্যবধানে থাকতেন বর্তমানে কারাগারে থাকা নিজনান্দুয়ালী পূর্বপাড়ার বাসিন্দা আয়ুব আলীর বাবা মোঃ ওমেদ আলী ওরফে ওমেদ শেখ। স্থানীয়রা বলছেন, বাদির বাড়ি পাবনা হওয়ায় তিনি ওই ব্যাক্তির বাবার নাম ভুল লেখেন।
বর্তমানে কারাগারে থাকা মোঃ আয়ুব আলীর আইনজীবী মোঃ মাহবুবুল আকবর বলেন, ‘মামলার এজাহারে আসামীর বাবার নামে ভুল থাকলেও জামিন নামায় তাঁর আসল বাবার নাম উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওই আসামীর বাবার নাম ভুল লিখেই অভিযোগপত্র দেন। বিচারকও সে অনুযায়ী রায় দিয়েছেন। এই গাফিলতির কারণে আসল আসামীকে ছেড়ে একজন নিরাপরাধ ব্যাক্তিকে জেল খাটতে হচ্ছে’।