‘সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ’– এ শিরোনাম বাংলাদেশের মানুষের খুব চেনা। গত সাত বছরে বহুবার এমন শিরোনাম অবধারিতভাবে সামনে আনছে সেই প্রশ্ন– সংকট আসলে কোথায়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই সাত কলেজের একটি ঢাকা কলেজ। সেই কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান বলছেন, তাদের সমস্যা অনেক, কিন্তু আত্মপরিচয়ের সংকটই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়হীনতায় ভুগছে সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা। আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে নানান সমস্যার সম্মুখীন হই।”
ক্ষমতায় পালাবদলের পর এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছেন। রহমান সেই আন্দোলনকারীদের অন্যতম ‘ফোকাল পার্সন’।
তার ভাষায়, আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করে দেওয়াটাই এখন সাত কলেজের সব সমস্যা সমাধানের ‘একমাত্র উপায়’।
রাজপথের আন্দোলনের সমান্তরালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মও গড়ে তুলেছেন তারা।
এই কলেজগুলোর মধ্যে তিতুমীর কলেজের অনেক শিক্ষার্থী আবার চাইছেন, শুধু তাদের কলেজ নিয়েই একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক।
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এবার কলেজগুলোর অধিভুক্তি বাতিলের দাবি তুলেছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ সমস্যার দায় চাপিয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর, যাদের সিদ্ধান্তে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল।
তার ভাষায়, সেই ‘অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের’ কারণে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাত কলেজ– উভয় পক্ষকেই ভুগতে হচ্ছে।
তবে শিক্ষার্থীদের মূল দাবি ‘স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একমত নয়। কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, সেই সুপারিশ দিতে সরকার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করে দিয়েছে।
কেন এই অধিভুক্তি?
এক সময় দেশের সব ডিগ্রি কলেজ পরিচালিত হত ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৯২ সালে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে তখনকার বিএনপি সরকার।
কিন্তু বিপুল সংখ্যক কলেজ সামলাতে গিয়ে হিমশিম দশা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। সময় মত পরীক্ষা নেওয়া বা ফল প্রকাশ করতে না পারায় দেখা দিদেয় দীর্ঘ সেশনজট। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে দেখা দেয় স্থবিরতা। সনদের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা তখনও রাস্তায় নেমেছিলেন।
২০১৪ সালের শেষ দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার নির্দেশ দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরের বছর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার প্রক্রিয়া ত্বরাণ্বিত করার তাগিদ দেন।
এর ধারাবাহিতায় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাত সরকারি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়।
কলেজগুলো হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
সে সময় সিদ্ধান্ত হয়, এসব কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সে সময় কলেজ ছিল দুই হাজার ১৫৪টি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ লাখের বেশি।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হওয়া সাত কলেজে তখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন শিক্ষার্থী এবং এক হাজার ১৪৯ জন শিক্ষক ছিলেন।
সে সময় দেশের অন্য সরকারি কলেজগুলোকেও ধারাবাহিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল, কিন্তু সাত কলেজের পর সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি।