মাগুরার সাংবাদিক সমাজে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। বিভিন্ন সরকারি অফিসে গিয়ে সাংবাদিকরা বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছেন। সাংবাদিকদের এই বিভক্তি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন সরকারি কর্মকর্তা থেকে বিভিন্ন অংশীজনেরা।
গত ৩ মে ছিল আন্তর্জাতিক মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এ দিবস উপলক্ষে দুইটি আলাদা জায়গায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মাগুরার সাংবাদিকেরা। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওইদিন বেলা ১১টায় আলোচনাসভা এবং শোভাযাত্রার আয়োজন করে মাগুরা প্রেসক্লাব। অন্যদিকে বিকেল ৩টায় শহরের সৈয়দ আতর আলী পাবলিক লাইব্রেরীতে সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে মাগুরা জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক (এমজেএন) ও মাগুরা রিপোর্টার্স ইউনিটি কল্যাণ সংস্থা।
৩ মে একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ‘সাহসী নতুন বিশ্বে রিপোটিং,স্বাধীন গণমাধ্যমে এ আইয়ের প্রভাব’ এ শ্লোগান নিয়ে মাগুরায় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করে মাগুরা প্রেসক্লাব। মাগুরা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন মাগুরা প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা। সভায় মুক্ত সাংবাদিকতায় বাঁধা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাসহ বস্তুনিষ্ট ও সৃজনশীল সংবাদ পরিবেশন নিয়ে আলোচনা করা হয়। আলোচনা শেষে শহরে একটি র্যালী বের করেন প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা।
৩ মে মাগুরা প্রেসক্লাবে আন্তর্জাতিক মুক্ত গণমাধ্যমে আলোচনা সভার আয়োজন। ছবিঃ সংগৃহীত।
অন্যদিকে ৩ মে দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে ‘গুজব ও অপতথ্য রোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালার মধ্য দিয়ে মাগুরা জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক (এমজেএন) ও মাগুরা রিপোর্টার্স ইউনিটি কল্যাণ সংস্থার অনুষ্ঠান শুরু হয়। এতে জেলা সদর ও উপজেলার দুই ডজনের বেশি সাংবাদিক অংশ নেন। কর্মশালা শেষে বিকেল ৫টায় শুরু হয় দ্বিতীয় অধিবেশন। সাংবাদিক ও অংশীজনদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভার শিরোনাম ছিল ‘মফস্বলে পেশাদার সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’। আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সাংবাদিক দৈনিক যুগান্তর প্রতিনিধি আবু বাসার আখন্দ, প্রথম আলোর সাংবাদিক কাজী আশিক রহমান, ডিবিসি নিউজ ও আজকের পত্রিকার সাংবাদিক ফয়সাল পারভেজ, মোহনা টেলিভিশনের এইচ এন কামরুল ইসলাম, দীপ্ত টিভির কাশেমুর রহমান শ্রাবণ, রিপোর্টার্স ইউনিটির আহবায়ক মিরাজ হাসান, খোলা কাগজের মাসুম বিল্লাহ, সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রভাষক ইমরান নাজির, জেলা জাসাসের সভাপতি কাজী সিরাজ মিহির, বিতার্কিক নাহিদুর রহমান দুর্জয়, সাংস্কৃতিক কর্মী মিজান শরীফ, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহেদ হাসান টগর, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও দৈনিক মাগুরার প্রকাশক এম মাহবুবুল আকবর কল্লোল, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি এটিএম মহব্বত আলী, জেলা জামায়াতের সাবেক আমীর আব্দুল মতিন, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক আহসান হাবীব কিশোর, লেখক ও সোশ্যাল মিডিয়া এ্যক্টিভিস্ট জাহাঙ্গীর কবীর প্রমুখ। আলোচকরা বলেন, সাংবাদিকদের জ্ঞানের সল্পতা, নিরাপত্তার অভাব, আর্থিক নিরাপত্তা না থাকা, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক চাপ, প্রলোভনসহ নানা কারণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বর পথে বড় বাঁধা।
৩ মে আতর আলী পাবলিক লাইব্রেরীতে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সাংবাদিক আবু বাসার আখন্দ।
স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল মাগুরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকদের দুটি পক্ষ। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওইদিন বেলা ১১টায় ‘গুজব ও অপতথ্য রোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা শীর্ষক’ সেমিনারের আয়োজন করে খুলনা আঞ্চলিক তথ্য অফিস (পিআইডি)। খুলনা আঞ্চলিক তথ্য অফিসের উপ-প্রধান তথ্য অফিসার এ এস এম কবিরের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাশ্বতী শীল। সেমিনারে অংশ নেন জেলার বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেন্ট্রনিক মিডিয়ার প্রায় ৩০ জন সাংবাদিক।
মাগুরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ৩০ এপ্রিল সেমিনারে সাংবাদিকরা।
ওইদিন অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও এসএ টিভির সাংবাদিক আব্দুল আজীজের বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। এসময় প্রেসক্লাবের সাংবাদিক নেতাদের পক্ষ থেকে তাঁকে বক্তব্য দিতে বাঁধা দিলে উভয় পক্ষ বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে, সভাপতির আনুষ্ঠানিক বক্তব্য ছাড়াই অনুষ্ঠান শেষ হয়। সেমিনারের সভাপতি খুলনা আঞ্চলিক তথ্য অফিসের উপ-প্রধান তথ্য অফিসার এ এস এম কবির বলেন, ‘আপনাদের আলোচনায় অনেক ভালো ভালো পয়েন্ট উঠে এসেছিল। এগুলো নিয়ে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখন সেই পরিবেশ নেই। আমরা চাইলে অন্য জেলাতেও এ আয়োজন করতে পারতাম। ভবিষ্যতে আপনারা সহযোগিতা করলে আবার দেখা হবে’।
সাংবাদিকদের বিভক্তি ও বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানতে চাইলে মাগুরা প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইদুর রহমান বলেন, ‘দেখুন সাংবাদিকরা নিজেদের প্রয়োজনে আলাদা আলাদা সংগঠন পরিচালনা করছেন। আলাদা আলাদা সংগঠন আলাদা আলাদা ভাবে যদি প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করে সেখানে আমার কি বলার থাকতে পারে। তবে একসঙ্গে হলে ভালো হতো’।
এ বিষয়ে মাগুরা জার্নালিস্ট নেটওয়ার্কের সভাপতি রবিন শামস বলেন, ‘মাগুরার সাংবাদিকতা ও সার্বিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে এমজেএন এর যাত্রা শুরু। এই সংগঠনে স্থানীয় সাংবাদিকদের পাশাপাশি ঢাকাস্থ মাগুরার সাংবাদিকরাও সদস্য রয়েছেন। আমরা গত দেড় বছরে জেলার সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নে বেশ কয়েকটি কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করেছি। কিন্তু এখানে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেল স্থানীয় সাংবাদিকরা এক অদৃশ্য কারণে বিভক্ত। এটা কাম্য না। ছোট এই শহরে এমন বিভক্তি থাকলে কাজ করা যায় না’।
এদিকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের দুইটা গ্রুপের মুখোমুখি অবস্থানের বিষয়ে মাগুরা প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমি প্রেসক্লাবের সভাপতি তাঁরা (প্রেসক্লাবের সদস্য নয় এমন সাংবাদিকেরা) ওই সেমিনারে বক্তব্য দেওয়ার অনেক সময় পেয়েছিল। আগে কোন কথা না বলে আমার কথার পরে যেয়ে তাদের কেন কথা বলতে হবে? এটা কি একটা শিষ্টাচার বহির্ভূত ঘটনা নয়?’।
ওইদিন বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রেসক্লাবের সাংবাদিক নেতাদের বাঁধার মুখে পড়েন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ও এসএ টিভির সাংবাদিক আব্দুল আজীজ। এ বিষয়ে সাংবাদিক আব্দুল আজীজ বলেন, ‘সেমিনার আয়োজন করা হয়েছিল সাংবাদিকদের কথা শোনার জন্য। ওখানে কে কখন বক্তব্য দেবেন সে বিষয়ে বলতে পারেন ওই অনুষ্ঠানের সভাপতি বা সঞ্চালক। যারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাঁদের পক্ষ থেকে আপত্তি থাকলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ওনারা (প্রেসক্লাবের নেতারা) আমাকে বা একজন সাংবাদিককে বক্তব্য দিতে বাঁধা দেওয়ার কে?’।
সাংবাদিকদের এমন আচরণে বিব্রত সরকারি কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে তাঁরা কেউই প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে চান নি। তবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশের শর্তে জানান, মাগুরার সাংবাদিকদের এই গ্রুপিং নিয়ে রীতিমত তাঁরা আতঙ্কিত থাকেন। কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলে তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এক পক্ষকে দাওয়াত দিলে অন্য পক্ষ চাপ তৈরি করে। এমনকি এখন সাংবাদিক সংগঠনের দাওয়াতও এড়িয়ে চলছেন অনেক কর্মকর্তা। তাঁদের একজন বলেন, ‘সাংবাদিকদের উপর সমাজের অনেক ভালো মন্দ নির্ভর করে। কিন্তু তাঁরা যদি একে অপরকে সম্মান না দেন তাহলে তাঁদের মাধ্যমে সমাজে কি বার্তা যাচ্ছে?’
মাগুরা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের উপর হামলার প্রতিবাদে সাংবাদিকদের মানববন্ধন। মাগুরা প্রেসক্লাবের সামনে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের ছবি।
সাংবাদিকরা জানান, মাগুরার সাংবাদিকদের বিভক্তি প্রকাশ্যে এসেছে ২০২৪ সালে। ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি মাগুরা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক আব্দুল আজীজের উপর হামলা চালায় একদল সাংবাদিক। এ বিষয় নিয়ে সাংবাদিকরা মানববন্ধন স্মারকলিপিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এছাড়া প্রেসক্লাবের নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ এনে ওই বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে মাগুরা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে এডিআর করেন এক সাংবাদিক। তবে লিগ্যাল এইড কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওই এডিআর অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়।