1. dainikmagura@gmail.com : magura :
নোমানী ময়দান: শহরের প্রাণ যেন হারিয়ে না যায় | দৈনিক মাগুরা
বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ০৬:২৮ অপরাহ্ন

নোমানী ময়দান: শহরের প্রাণ যেন হারিয়ে না যায়

এম মাহবুবুল আকবর
  • আপলোডের সময় : বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই, ২০২৫
  • ২৬০ জন দেখেছেন
মাঠের এক কোনে খেলছে শিশুরা।

মাগুরার মানুষের আবেগ, স্মৃতি আর ঐতিহ্যের নাম নোমানী ময়দান। এই মাঠে খেলেই অনেক কিশোর তারুণ্যে পৌঁছেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বহু দশক ধরে এটি শুধু খেলাধুলার মাঠ নয়, বরং ঈদের প্রধান জামাত, জাতীয় অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এক কথায়, এটি ছিল মাগুরা শহরের একমাত্র উন্মুক্ত প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নোমানী ময়দানে যেভাবে বেপরোয়াভাবে দোকান বসেছে, তাতে মাঠের অস্তিত্ব ও পরিবেশ দুটোই আজ হুমকির মুখে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে—এই মাঠের দখল শুরু আজকের নয়। প্রায় চার দশক আগে, যখন এখানে মিলনায়তন ও শিল্পকলা একাডেমি গড়ে ওঠে, তখন থেকেই মাঠের আয়তন কমতে শুরু করে। পরবর্তীতে এখানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ হয়। এছাড়া দিনান্ত ক্লাব, এবং আনসার ভিডিপি কার্যালয় ধীরে ধীরে মাঠের প্রাকৃতিক বিস্তারকে সংকুচিত করে। তখন থেকেই একটি ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠ প্রশাসনিক ও সামাজিক স্থাপনার চাপে পড়ে যায়।

প্রশাসনের সাম্প্রতিক উদ্যোগ ছিল শহরের ফুটপাতের দোকান সরিয়ে কিছু ব্যবসায়ীকে পুনর্বাসন করা। উদ্দেশ্য ছিল ভালো। কিন্তু মাঠের সীমানা রক্ষা না করে, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যবসা চালুর অনুমতি দেওয়ায় সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। মাত্র ১০-১২টি ভ্রাম্যমাণ দোকানের কথা থাকলেও বর্তমানে সেই সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। মাঠের সীমানা, শহীদ বেদী এলাকা, এমনকি খেলার মূল অংশেও এখন জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। খেলার মাঠে বসেছে ভ্যান, এমনকি দুইতলা দোকান। ফলে খেলার জায়গা সংকুচিত হচ্ছে, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত। ঘাসহীন মাঠে এখন খেলোয়াড়রা ইনজুরিতে পড়ছে, শিশুরা আসতেই পারছে না।

ছাত্র-যুবকদের অভিযোগ, এখন মাঠে নিয়মিত খেলা সম্ভব নয়। আগে যেখানে একসাথে কয়েকটি দল খেলত, এখন একটি দল খেলতে গেলেও জায়গা পাওয়া যায় না। দোকান থেকে ফেলা হয় উচ্ছিষ্ট, বোতল, প্যাকেট। মাঠে নেই ঘাস, চারদিকে কেবল ময়লার স্তূপ। এই পরিস্থিতি শুধু খেলাধুলায় বিঘ্ন ঘটায় না, শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ ও সামাজিক শৃঙ্খলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

একটি উদ্বেগজনক দিক হলো, মাঠে বর্তমানে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণও চলছে। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং শিশুদের জন্য বিপজ্জনক। নোমানী ময়দান কোনো ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার নয়, এটি জনগণের খেলার ও বিনোদনের উন্মুক্ত স্থান। এখানে শিশু-কিশোরদের দৌড়ানোর কথা, বাইক চালানোর নয়।

অবশ্য উদ্যোক্তাদের কথাও অগ্রাহ্য করা যায় না। তাঁরা বলছেন, দোকান বসার ফলে সন্ধ্যার পরও মাঠ এলাকায় লোকসমাগম বাড়ছে, পরিবার আসছে, কর্মসংস্থানও তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই সুবিধা কি এমনভাবে দেওয়া উচিত, যাতে শহরের ঐতিহ্য হারিয়ে যায়? মাঠের শ্বাসরুদ্ধ দশা কি আমরা মেনে নিতে পারি?

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ বেহাল

আমরা বলছি না সব দোকান তুলে ফেলুন। তবে একটি পরিকল্পিত সমাধান জরুরি। মহিলা কলেজের পুকুরপাড়, গোরস্থান রোড, ঢাকা রোড জোড়া ব্রিজের দুপাশে নবগঙ্গা নদীর পাড়ে, স্টেডিয়ামের পাশে খালি খাস জায়গা ও জেলা পরিষদের বাংলোর গেট পর্যন্ত নির্দিষ্ট নকশা ও শর্তে একেক জায়গায় সীমিত সংখ্যক ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো যেতে পারে। দোকানগুলো যেন সব ভ্রাম্যমাণ হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর সরিয়ে নিতে হয়, সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে। মাঠের মূল অংশ ও শহীদ বেদী চত্বর অবশ্যই খালি রাখতে হবে। এটাই শহরের ঐতিহ্য, এখানেই তরুণ প্রজন্মের শৈশবের বিকেল।

এখন প্রয়োজন নাগরিক উদ্যোগ। মাঠ রক্ষা করতে হবে আমাদেরই। তরুণদের খেলাধুলা, শিশুদের হাঁটাহাঁটি, প্রবীণদের গল্পের আড্ডা—এই সব মিলেই নোমানী ময়দান। এটিকে শুধু “ব্যবসার স্থান” ভাবলে ভুল হবে। প্রশাসনের পাশাপাশি নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। এই মাঠ যেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও একইভাবে জীবন্ত থাকে।

নোমানী ময়দান বাঁচুক। শহর বাঁচুক। আমাদের সংস্কৃতি, খেলাধুলা আর শিশুর শৈশব বাঁচুক।

নোমানী ময়দান যেন হারিয়ে না যায়…
শহরের প্রাণ যেন প্রাণহীন না হয়।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© ২০২১-২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত | দৈনিক মাগুরা.কম
Theme Designed BY Kh Raad ( Frilix Group )