কবে ব্রাজিল পাঁচ গোলের ব্যবধানে কোনো ম্যাচ জিতেছে, খুঁজতে খুঁজতে ঠিক পাঁচ বছর পেছাতে হয়। ২০২০ সালের আজকের দিনে বলিভিয়ার বিপক্ষে ৫-০ গোলে জিতেছিল ব্রাজিল।
সেটি ছিল বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ। তার ঠিক পাঁচ বছর পর আজ সিউলে সাউথ কোরিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিল নেমেছে প্রীতি ম্যাচে। কার্লো আনচেলত্তি দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্রাজিলের পঞ্চম ম্যাচ এটি। তাতে আজও ৫-০ গোলেই জিতেছে ব্রাজিল!
নেইমারকে তো প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় দলেই পাচ্ছে না ব্রাজিল। আজ এই চোট, কাল ওই চোটে ব্রাজিলের ফুটবলে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন যেন কুলিয়েই উঠতে পারছেন না। ব্রাজিলের জার্সিতে তাঁকে সর্বশেষ দেখা গেছে সেই ২০২৩ সালের অক্টোবরে। আনচেলত্তির অধীনে এখনো ব্রাজিলের হয়ে খেলার অপেক্ষায় থাকা নেইমারের অনুপস্থিতি ব্রাজিল কীভাবে সামলে নেয়, আনচেলত্তি কী কৌশল সাজান – সেসব দেখার ছিল আজকের ম্যাচে। বলা যায়, ব্রাজিল সমর্থকদের মন ভরেছে, নেইমারের অনুপস্থিতি নিয়ে শঙ্কাও বুঝি-বা কিছুটা কেটেছে।
আসল নেইমার নেই, কিন্তু ব্রাজিল দলে একেক সময়ে ‘নতুন নেইমার’ ট্যাগ পাওয়া তিন তরুণ ফরোয়ার্ড যে আছেন! আজ সেই তিনজন – ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো ও এস্তেভাওকে একসঙ্গেই নামিয়ে দিয়েছেন আনচেলত্তি। পাঁচ গোল করেছেন এই তিনজনই। রদ্রিগো ও এস্তেভাও দুটি করে, অন্যটি ভিনিসিয়ুস।
শুধু এ তিনজনই নন, সঙ্গে মাতেউস কুনিয়াকেও নিয়ে চার ফরোয়ার্ড নামিয়েছেন আনচেলত্তি! ইদানিং চার ফরোয়ার্ড নিয়েই ব্রাজিলকে খেলাচ্ছেন দলটার ইতালিয়ান কোচ। দুই মিডফিল্ডার কাসেমিরো আর ব্রুনো গিমারায়েসের সামনে চার ফরোয়ার্ড – মূলত কাগজে-কলমে ৪-২-৪ ছকে নামা ব্রাজিলের সামনে পাত্তাই পায়নি সাউথ কোরিয়া!
এই ছকে যাওয়া মানে রক্ষণ থেকে দ্রুত আক্রমণে ওঠার ‘কুইক ট্রানজিশন’ কৌশলেই খেলার কথা, তা-ই খেলেছে ব্রাজিল। চার ফরোয়ার্ড বল পায়ে না থাকলে সাউথ কোরিয়ার রক্ষণকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছেন প্রেসিংয়ে, আর বল পায়ে পেলে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন ‘কম্বিনেশন প্লে’ আর পাসিংয়ে। ভিনি আর রদ্রিগো লেফট উইং আর সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং পজিশনে অদলবদল করে খেলেছেন, মাতেউস কুনিয়া করেছেন মাঝমাঠ আর আক্রমণের সমন্বয়। আর এস্তেভাও ডানদিক ধরে দ্রুতগতিতে উঠেছেন আর নেমেছেন, কোরিয়ানদের ভুগিয়েছেন।
১৩ মিনিটে জমাট রক্ষণের মধ্য দিয়েই গিমারায়েসের অসাধারণ থ্রু, ‘ভূতে’র মতো করে অগোচরে কোরিয়ান রক্ষণকে ফাঁকি দিয়ে উঠে যাওয়া এস্তেভাও পাসটা ধরে বল জালে ঢুকিয়ে দিলেন। এরপর ব্রাজিলের নিরন্তর প্রেসিং, পাসিং আর গতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বারবার খেই হারিয়েছে কোরিয়া। উপায়ান্তর না পেয়ে ট্যাকটিক্যাল ফাউল করেছে বারবার, দুটি হলুদ কার্ডও দেখেছে তা করতে গিয়ে। গোলকিপার হিউওন-উ দুবার ঠেকিয়েছেন ভিনি আর রদ্রিগোর শট, কাসেমিরোর একটা গোল বাতিল হয়েছে অফসাইডে।
কিন্তু বিরতির আগে আর পরে ব্রাজিলকে যেন গোলের ‘মুডে’ পেয়ে বসেছে! ভিনিসিয়ুস-কাসেমিরোর পা হয়ে আসা দারুণ মুভের পর অসাধারণ ফিনিশিংয়ে রদ্রিগো ব্রাজিলের দ্বিতীয় গোলটি করলেন ৪১ মিনিটে, বিরতির পর ৪৭ থেকে ৪৯ – তিন মিনিটের মধ্যে আরও একটি করে গোল এস্তেভাও ও রদ্রিগোর। এস্তেভাওয়ের গোল এল বায়ার্ন মিউনিখে খেলা কোরিয়ান ডিফেন্ডার কিম মিন-জের ভুল পাস ধরে, রদ্রিগো দিলেন ভিনিসিয়ুসের পায়ে শুরু দারুণ মুভে সমাপ্তি। ৭৭ মিনিটে ব্রাজিলের গোল-উৎসবে যোগ দিলেন ভিনি নিজেও।
মে মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্যাকটিকসের চেয়েও ব্রাজিলের ড্রেসিংরুমে আত্মবিশ্বাস আর শৃঙ্খলা ফেরানোর দিকে বেশি নজর দেওয়া আনচেলত্তি এ নিয়ে তৃতীয় জয়টা তুলে নিলেন। আজকের জয়ের বিশেষত্ব, গোলের সংখ্যার চেয়েও গোলের ধরন। আর পারফরম্যান্সের পূর্ণতা। ম্যাচ শেষে ব্রাজিলের টিভি গ্লোবোতে রদ্রিগো মেতেছেন আনচেলত্তির প্রশংসায়, ‘সবাই সবটুকু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া আর খুনে মেজাজ নিয়ে খেলার দিকে বেশি জোর দেন তিনি (আনচেলত্তি), সেটার শুরুটা ফরোয়ার্ডদের প্রেসিংয়ে জোর দেওয়ার মাধ্যমে। সবাই ডিফেন্ড করবে, সবাই দলকে সাহায্য করবে…। ধীরে ধীরে আক্রমণটা গুছিয়ে উঠছে। আজকের এই জয় আর আমার নিজের পারফরম্যান্সে আমি খুশি। এটা ধরে রাখতে হবে।’
আগামী মঙ্গলবার জাপানের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে আরেকবার এমন পারফরম্যান্স দেখানোর দায় এখন রদ্রিগো-ভিনিদের। বাছাইপর্ব শেষে এখন বিশ্বকাপে চোখ রেখে একের পর প্রীতি ম্যাচ খেলতে যাওয়া ব্রাজিল ফলের চেয়েও পারফরম্যান্সটা এই মানে ধরে রাখার সহজ অর্থ তো এটাই যে, আট মাস পরের বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে ‘ব্রাজিল’ মনে হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া।